রসুলপুর স্টেশন


 

দিনের প্রথম ট্রেনটা স্টেশন ছেড়ে চলে যায় খুব ভোরে। তারপরই কেমন যেন এক আলসেমি ভর করে রসুল্পুর স্টেশনে। আচ্ছা, এই স্টেশনটার নাম রসুল্পুর কেন? কেউ কি ভেবে দেখেছে সে কথা? ভাবেনি। এই গ্রামের মানুষজন খুবই সরল। এসব চিন্তা তাদের মাথায় ধরে না। তারা শুধু জানে দিনে দুই বার একটা ট্রেন শহরে চলে যায় আবার ফিরে আসে। বাকি সময় তারা স্টেশনের পাশের বাজারে বসে আড্ডা দিয়ে সময় কাটায়। এসব ভাবার কথাও না তাদের। এসব ভাবে একজন। তার নাম অনু। কয়েক বছর হল সে এই গ্রামে বউ হয়ে এসেছে। সেই থেকে দেখছে এই গ্রামের মানুষজনের জীবন খুবই সরল রেখায় চলে। অনেকটা সেই ট্রেনের মত। লাইনের বাইরে যায় না।

সে সারাদিন বসে এসব ভাবে। আর ভাবে শিমুলের কথা। শিমুল তার স্বামী। সে শহরে থাকে। মাঝে মাঝে সেই ট্রেনটা চড়ে আসে বাড়িতে। তাও বছরে এক কি দু’বার। তবে অনুকে সে ফোন করে। অনুর নিজের ফোন নেই। বাজারে সেলিম ভাইয়ের দোকানে ফোন আছে সেটায় ফোন করে। সেলিম ভাই দৌড়ে আসে ফোন নিয়ে আর চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘শিমুল ভাইয়ের ফোন… শিমুল ভাইয়ের ফোন।“ অনুর ভীষণ রাগ হয়, লজ্জাও করে। এভাবে পুরো গ্রাম জানিয়ে আসার কি আছে? তার ইচ্ছে হয় শিমুলকে বলে তাকে যেন একটা ফোন কিনে দেয়। তাহলে সে সারাদিন, সারারাত কথা বলবে শিমুলের সাথে। কিন্তু তার ইচ্ছের কথা সে কাওকে জানায় না। শিমুলকেও না। সে জানে শিমুলের কাঁধে অনেক দায়িত্ব। প্রতি মাসে মায়ের ঔষধ, বোনের লেখাপড়ার অনেক খরচ। তাই সে আর কিছু বলে না, লুকিয়ে ফেলে কথা। মানুষ হওয়ার এই এক জ্বালা। চাইলেই সব বলে ফেলা যায় না। আচ্ছা, পাখিদেরও কি লুকোতে হয় কিছু? গাছেদের? ফুলেদের? না তো! শুধু মানুষকেই। অনুর মনে হয় মানুষ প্রাণীটা খুব অদ্ভুত। একেকজন একেক রকম। অথচ সব চড়ুই এক, সব জবা দেখতে এক, এমন কি সব ঘাসও দেখতে একইরকম। তবে মানুষই শুধু ভিন্ন।

এই মানুষ প্রাণীটার ওপরেই অনুর যত রাগ। এই যেমন হরির দাদি, তার শাশুড়ির ছোটকালে সই। প্রায়ই আসে তার শাশুড়ির সাথে গল্প করতে। সেদিন তাকে দেখে বলে, “বৌঠান দেখেশুনে রাইখো। বি-দ্যাশ বড় খারাপ জায়গা। ছুইটা না যায়।“

এসব শুনলে অনুর গায়ে জ্বালা ধরে যায়। সে জানে শিমুল এমন না। কিছুতেই অমন হতে পারে না। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে কান্না লুকোয়। লুকিয়ে ফেলার একরকম অভ্যাস হয়ে গেছে তার। এইযে সে সারাদিন শিমুলের কথা ভাবে কেউ কি জানে? কেবল সে-ই জানে। পাড়াগাঁয়ে স্বামীর নাম মুখে আনতে নেই এমন একটা রীতি আছে। কিন্তু সেটা অনুর মানতে কষ্ট হয়। কেন ডাকবে না? এত সুন্দর নাম, শিমুল। সে বারবার ডাকবে। মনে মনে সে সারাদিন ডাকে শিমুল, শিমুল, শিমুল। কিন্তু সামনাসামনি ভীষণ লজ্জা লাগে। অনেকবার চেষ্টা সে করেছে ডাকার। কিন্তু পারেনি। তাই সে মনে মনেই ডাকে।

সময় হলেই সে বাড়ির পেছনের পুকুর ঘাটে গিয়ে বসে সাবধানে। শ্যাওলা জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। ঘাটটাও ভাঙ্গা। তাতে তার সমস্যা হয় না। বরং ভালই লাগে। এখানে বসলে কত কথা তার মাথায় আসে। শিমুলের কথা, এই গ্রামের মানুষদের কথা, ছোট্ট স্টেশনটার কথা, দু’বেলা ছেড়ে যাওয়া অজগরের মত অত বড় ট্রেনটার কথা। ট্রেনটাকে তার খুব আপন মনে হয়। সে দিনে দু’বার শহরে যায়। যে শহরে তার শিমুল থাকে। অনুর ইচ্ছে করে ট্রেনটাকে রোজ ছুঁয়ে দিতে। কে জানে শিমুলের স্পর্শ পাওয়া যায় যদি! এসব ভাবতে ভাবতে সে নিজের মনেই হাসে। সে কি কবি হয়ে যাচ্ছে? মহিলা কবি! না না, মহিলা কবি কেমন যেন শোনায়। সে হল অনু কবি। শিমুল কে নিয়ে একটা কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয় তার। শিমুল আবার যেদিন ফিরবে তার জন্য শহর থেকে লাল পাড়ের শাড়ী নিয়ে। খুব রাতে আলতো করে তার কানে কানে বলবে, “শাড়ীটা পড়ে আমার সামনে এসো”। তখন সে খুব যত্ন করে শাড়ী পরবে, চোখে কাজল দিবে, খোঁপায় ফুল গুঁজবে, সুগন্ধি মাখবে। শিমুলের পাশে বসে তখন সে তার লেখা কবিতাটাও শোনাবে। এসব ভাবতে ভাবতে হেসে ফেলে অনু।

তখনই বাড়ির ভেতর থেকে তার শাশুড়ির গলা শুনে ঘোর কাটে তার। অনেকক্ষণ হল সে পুকুর পাড়ে। তার শাশুড়ির ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে। সে উঠে পরে। উঠতে গিয়ে চোখ পরে তার পুকুর পাড়ে জবা ফুল গাছটায়। মস্ত এক রক্তজবা ফুটেছে ডালে। মৃদু হাওয়ায় দুলে দুলে যেন হাসছে। যেন বলতে চাইছে, “তুমি কি ভাবছো সব কিন্তু আমি জানি।“

অনু কাছে এগিয়ে যায় ফুলটার। আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে মনে মনে বলে, “তুই কিন্তু ঝরে যাস না যেন। শিমুল ফিরলে তোকে খোঁপায় গুঁজে তার সামনে যাব।“

অমনি ফুলটা দুলে ওঠে। যেন মাথা নাড়িয়ে বলতে চাইছে ‘আচ্ছা’।

তারপরই অনু ভাবে শাশুড়ি যদি জিজ্ঞেস করে ‘এতক্ষণ পুকুর পাড়ে কি করছিলে?’, সে কি বলবে? তাকে কথা লুকোতে হবে। বলা যাবে না যে শিমুলের কথা ভাবছিল সে। তার ভীষণ লজ্জা করে। মানুষ হওয়ার এই এক যন্ত্রনা। চাইলে সব বলে ফেলা যায় না। কিছু কথা বুকের ভেতর যত্ন করে লুকিয়ে রাখতে হয়। যেন কেউ না জানে।

রক্তজবাটা আবার দুলে উঠলো। যেন বলতে চাইলো, "ঠিক ঠিক!" 


-০-

Comments

Popular posts from this blog

খুনী

কথা ও আকাশ