মতি মাঝি


‘বোল উনলোগকা ক্যাম্প কিধার হ্যাঁয়?’- চিৎকার করে ওঠে মিলিটারি কমান্ডার।

‘কইলাম তো আমি কমু না’- পূর্ববৎ উত্তর দেয় মতি মাঝি।

ঘরটা ছোট। মেথিকান্দা প্রাইমারী স্কুলের একটা ক্লাসরুম। যুদ্ধ লাগার পর থেকে এই স্কুলটি মিলিটারির দখলে। তারা এখানে ক্যাম্প গেড়েছে। মতি মাঝিকে তারা ধরে এনেছে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের খোঁজ দিতে। তাদের ধারনা মতি মাঝির সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশ ভাল মেলামেশা আছে। যে ছোট ঘরটাতে মতি মাঝিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে সেটার ঠিক মাঝখানে একটা টেবিল। তার দুপাশে দুইটা চেয়ার। একটা চেয়ারে মতি মাঝি কে বেঁধে রাখা হয়েছে। সেই চেয়ারটা একটু নড়বড়ে। তার ঠিক অপর প্রান্তের একটা চেয়ারে বসে আছে মিলিটারি কমান্ডারটা। ঠিক কমান্ডার কিনা মতি মাঝি তা জানে না। কিন্তু ভাবসাব আর চেহারা দেখে কমান্ডারই মনে হয়।

‘তু জান্তা হ্যাঁয় উনলোগকা ক্যাম্পকি বারেমে, বোল দে কিধার হ্যাঁয়, হাম তুঝে ছোর দেঙ্গে।’

মতি মাঝি কোন উত্তর দেয় না। কমান্ডারটা কতক্ষন ধরে এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে আর সে একই উত্তর দিচ্ছে, সে বলবে না। সে বলছে না যে সে জানে না। সে বলছে, সে বলবে না। কারন সে জানে তাদের ক্যাম্প কোথায়। আর জানবে নাই বা কেন। সে অনেক কিছুই জানে দের সম্পর্কে। তারা নদীর ওইপাশে একটা ভাঙ্গা বাড়িতে ক্যম্প করেছে সেটা জানে। তারা যে রাতের আঁধারে খালের উপরে ব্রিজটা উড়িয়ে দিয়েছে সেটাও মতি মাঝি জানে। সেই তো মাঝে মাঝে তাদের ক্যাম্পে ঔষধ, খাবার এমনকি অস্ত্রও নিয়ে গেছে। সে তো তাদের সম্পরকে জানবেই। কিন্তু সে তাদের ব্যাপারে মিলিটারিদের কিছু বলবে না। কিচ্ছু না। তারা যে তাকে অনেক বিশ্বাস করে। আচ্ছা সে তো মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করছে। তাহলে সেও কি মুক্তিযোদ্ধা?

এসব চিন্তা করতে করতে তার গায়ে শিহরন জাগে। তার শরীরটা কেপে ওঠে উত্তেজনায়। সেই কম্পন সঞ্চারিত হয় নড়বড়ে চেয়ারটাতে। চেয়ারতাও থুক থুক শব্দে নড়ে ওঠে।

‘চুপ কিউ হ্যাঁয় তু?’-জানতে চায় মিলিটারি কমান্ডারটা।

মতি মাঝি হঠাৎ আবিষ্কার করে কমান্ডারটার হাতে একটা বড় সূচ। কি করবে সে এই সূচ দিয়ে? ভেবে পায় না মতি মাঝি।

ঠিক তখনই  কমান্ডারটা পাশে দারিয়ে থাকা একটা সৈন্যকে ইশারায় কি যেন করতে বলে।

সৈন্যটি মতি মাঝির হাতের বাঁধন খুলে তার হাতটা সোজা করে টেবিলে চেপে ধরে। আঙ্গুলগুলো সোজা কমান্ডারটার দিকে।

মতি মাঝি এতক্ষনে বুঝতে পারে তার সাথে কি ঘটতে চলেছে।

কমান্ডারটা সূচের সুচালো  অংশটা মতি মাঝির মধ্যমা আঙ্গুলের নখের নিচে ঢুকিয়ে দেয়।

প্রচণ্ড চিৎকারে ফেটে পরে মতি মাঝি। রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা কয়েকটা কুকুরও এই শব্দ শুনতে পায়। অন্য সময় হলে ঘেউ ঘেউ করে তার প্রচণ্ড আর্তনাদে ফেটে পরত। কিন্তু এখন তারা কেবল কান খারা করে শোনেই কিন্তু কিছু করে না। ক্যাম্পের ভেতর থেকে এমন চিৎকার তো প্রতি রাতেই ভেসে আসে। এই শব্দ তাদের চেনা। প্রতি রাতেই শুনছে। প্রতিদিনই তো খালের পানিতে কত লাশ ভেসে যায়। তারা সেটা দেখে। শকুনেরা সে লাশের মাংস খুবলে খুবলে খায়। তারাও তো সেখানে ভাগ পায়।

‘ফিরভি নেহি বোলেগা তু?’- ফের প্রশ্ন করে কমান্ডারটা। কিন্তু মতি মাঝি কে কোন উত্তর দিতে না দেখে একটু ধৈর্য হারা হয়ে বলে-‘হারামি বাঙালি, বোল, নেহিতো......’

হারামি শব্দটা মতি মাঝির শরিরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। সে হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসে। পিচ করে এক দলা থুথু মেরে বসে কমান্ডারটার মুখে।

তারপর হঠাৎই সব নিরব। কমান্ডার বজ্রাহতের ন্যায় বসে থাকে। সে বুঝতে পারছে না কি হয়েছে। পকেট থেকে রুমালটা বের করে মুখ মোছে ধীরে।

কমান্ডারটার এই ধীর স্থির ভাব মতি মাঝিকে একটু ভয় পাইয়ে দেয়। ঝরের আগে যেমন প্রকৃতি একদম নিরব হয়ে যায়, এ নিরবতা সেরকমই। কমান্ডারটা হয়তো নিরব থেকে প্রচণ্ড বেগে ফেটে পরার জন্য শক্তি সঞ্ছয় করছে।

‘শেখকা চামচা...’ বলে চিৎকার করে এক ধাক্কায় সামনে থাকা টেবিলটা থাকা টেবিলটা উল্টিয়ে দিয়ে বুট দিয়ে প্রচণ্ড এক লাথি মারল মতি মাঝির বুকে। নড়বড়ে চেয়ারটা সহ উল্টে পরল মতি মাঝি।

‘শ্যুট হিম!’

 

রাতের নিরবতা গুলির শব্দ আশেপাশের কয়েকটা গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সে শব্দ কাওকে বিচলিত করতে পারে নি। পারবেই বা কিভাবে, এ তো নিত্যদিনের ব্যাপার!

(সমাপ্ত)



Comments

Popular posts from this blog

রসুলপুর স্টেশন

খুনী

কথা ও আকাশ