আঁধারের আর্তনাদ


এতদিন এখান-সেখান থেকে প্লট নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে বেশ গল্প ফেঁদেছি। তার একটাও কোন পত্রিকায় ছাপা হয়নি। তাই বলে আমি যে দমে গিয়েছি তা কিন্তু না। কলম আমার থেমে থাকেনি। লিখেছি অনবরত। কিন্তু আজ যে গল্প আমি লিখতে বসেছি তা কোন কল্পনা নির্ভর নয়। সত্য, কালোয় ছেয়ে যাওয়া রাতের আকাশের মতই সত্য এবং স্পষ্ট তা আমার কাছে। আজও এক দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করে বেড়ায় সেই দুঃসহ স্মৃতি।রহস্যের চাদরে ঢাকা, ইতিহাসের এক নির্মম সত্য।

প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনিতে ঘুম ভাঙল। কানে গোঁজা ইয়ারফোনে তখনও পিঙ্ক ফ্লয়েড বেজে চলেছে, So you run and you run to catch up with the sun but it’s sinking….। কিছুক্ষণ সময় লাগলো নিজের অবস্থানটা বুঝতে। আমি আছি এগারো সিন্ধুর এক্সপ্রেসের শোভন শ্রেনির একটা সীটে। যাচ্ছি নীলগঞ্জ- আমার বড় মামার বাসা। সিগন্যাল পরায় এতো জোরে ট্রেন ব্রেক কষেছে যে আমার ঘুমটাই ভেঙ্গে গেলো। ভৈরব জাংশন পার হয়েছি সেই কখন। এখন তো আর সিগন্যালে আটকানোর কথা না। হয়তো কোন গণ্ডগোল হয়েছে। বাংলাদেশের ট্রেনের কোন ভরসা নেই। 

বেশ কিছুদিন হল মাথা পুরো ফাঁকা, কোন গল্পের প্লট নেই মাথায়। তারওপর সেমিস্টার শেষে বেশ কিছুদিন ছুটিও পেয়ে গেলাম। তাই আমার এই নীলগঞ্জ যাত্রা! সময়টাও কাটবে আর উপরি পাওনা হিসেবে কিছু গল্পের প্লটও হয়তো মিলবে।  

বাম হাতটা সামনে এনে ঘড়িতে সময় দেখলাম। রাত দশটা বেজে কুড়ি। বুঝলাম বারোটা বেজে যাবে কিশোরগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছাতেই। কিশোরগঞ্জ স্টেশনে নেমে যেতে হবে আরও তিরিশ কিলো। নীলগঞ্জেও একটা ছোটো স্টেশন আছে। কিন্তু তাতে লোকাল আর একটা মেইল ছাড়া কোন ট্রেনই থামে না। তাই অগত্যা এই একটা মাত্র পথ। মামার স্টেশনে আসার কথা আমাকে নেয়ার জন্য।

বারোটা বাজেনি, তার ঠিক ১০ মিনিট আগেই ট্রেন প্ল্যাটফরম স্পর্শ করলো। আমি তলপিতলপা নিয়ে ট্রেন থেকে নামতেই দেখি প্ল্যাটফরমে মামা দাঁড়িয়ে আমার দিকেই হাত নাড়ছেন। বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে বোঝা যায়। প্ল্যাটফরম ভেজা, আর ঠাণ্ডা একটা হাওয়া বইছে চারদিকে। মামার সামনে দাঁড়িয়ে ঝোলাগুলো নামিয়ে রেখে টুক করে সালাম করে ফেললাম। মামা দুহাতে আমাকে থামাতে থামাতে বললেন, ‘আরে আয় আয়, সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি’।

‘এক সিগন্যালেই যত দেরি করিয়ে দিলো’, আমি বললাম।

‘চল চল, এখনও অনেকটা পথ’, এই বলে মামা হাঁটা ধরলেন। আমিও তলপিতলপা নিয়ে পিছু ধরলাম। মামার সম্পর্কে একটু বলে রাখা ভালো। উনি নীলগঞ্জ প্রাইমারী স্কুলের হেডমাস্টার। বয়স একটু হলেও এখনও বেশ শক্ত সমর্থ। নাকের নিচের পুরু গোঁফ আর কালো ফ্রেমের চশমায় মামার বাঙ্গালিয়ানা চেহারাটা বেশ নজর কাঁড়ে।

একটা অটোরিকশা বাইরেই অপেক্ষা করছিলো। উঠে বসলাম তাতে। রাতের বৃষ্টি ভেজা অন্ধকার রাস্তায় যেতে যেতে শীত শীত ভাবটা বেশ উপভোগ করছিলাম। বেশ খানিকটা পথ যাওয়ার পর অটোরিকশা থেমে গিয়ে চালক মামাকে বলল, ‘সার, আর যাওন যাইবো না। ক্যাদায় চাক্কা আইটকা যাইবো’।

মামা বললেন, ‘ঠিক আছে নামিয়ে দাও আমাদের। বাকিটুকু কাদা মাখামাখি হয়ে হেঁটেই যাওয়া যাবে’।

ঝোলাঝুলি নিয়ে নামলাম। মামা ভাড়া দিচ্ছেন এমন সময় কে যেন একজন আমার কানের ঠিক পেছনে বলে উঠলো, ‘আমার মাইয়াডারে দেখসেন?’

আমি চমকে লাফিয়ে উঠে বললাম, ‘কে? কে?’

পেছন ফিরে দেখি, একটা লোক কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে অটোরিকশার আলোতে কিছুটা আবছা আবছা দেখা যায়।

মামা বলল, ‘ভয় পাস নে। লোকটা পাগল। শিবু পাগলা’।

লোকটা আবার বলল, ‘আমার মাইয়াডারে দেখসেন সার? সেই যে গেলো আর তো……’। বলে থেমে গেলো, মনে হল কি যেন একটা মনে করার চেষ্টা করছে।     

মামা ধমক দিয়ে লোকটাকে তাড়িয়ে দিতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে তার মেয়েকে খুঁজছে কেন? হারিয়ে গেছে?’

মামা একটু হেসে বললেন, ‘ও বিশাল কাহিনী। আরেকদিন বলব। চল চল হাঁটা দিই। এই চলে এলাম বলে’।  

মামার বাসায় বেশ কাটছে দিনকাল। একদম গ্রামীণ পরিবেশে এর আগে কখনই এতদিন কাটাই নি। শহুরে যান্ত্রিকতা থেকে দূরে সরে এসে প্রকৃতিতে নিজেকে বেঁধে ফেলার এই আনন্দ বলে বোঝানোর মতো না। সকালে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়ি। মুগ্ধ হয়ে দেখি ঘাসের ডগায় তখনও শিশির কণা চকচক করছে সূর্যের আলো পড়ে। কখনও গাছের পাতার আড়ালে অচেনা কোন পাখির ডাকে খুঁজে বেড়াই পাখিটাকে কিংবা কখনও ঝোপে ফুটে থাকা অচেনা কোন বনফুল চেনার চেষ্টা করি। গাছপালা নিয়ে আমার মাতামাতিটা বরাবরই একটু বেশি। বিশেষ করে ঔষধি গাছ। তার ওপর আমি আবার ফার্মেসির ছাত্র। গাদা গাদা ঔষধি গাছের বৈজ্ঞানিক নাম আর তাদের রাসায়নিক উপাদান মুখস্ত করতে হয় অনবরত। যেসব গাছ এতদিন কেবল বইয়ের পাতায় দেখে এবং পড়ে এসেছি মাঝে মাঝে সেসবও খুঁজে পাই। অবাক বিস্ময়ে দেখি, কতশত রোগের ঔষধ বহন করা সেসব অমূল্য গাছ জন্মে আছে রাস্তার ধারে, ঝোপে-ঝাড়ে, কখনও ক্ষেতের পাশে নিতান্তই অযত্নে। প্রকৃতির দান!

দুপুর নাগাদ ফিরে আসি বাসায়। দুপুরে পেট পুরে খেয়ে অলস বাঙ্গালির মতো সামান্য একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়ি বিকেলে। মামা-মামির খাতির-যত্নে এই কয়দিনে আমার শুকনো শরীরেও যে চর্বির স্তর জমতে শুরু করেছে তা আমি হলপ করে বলতে পারি!

সেরকমই এক বিকেলে বেরুলাম প্রকৃতি পর্যবেক্ষণে। পাকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কখন যে কাঁচা মাটির রাস্তায় এসে পরেছি লক্ষই করিনি। বুঝতেই পারছি বেশ অনেকটা দূরে চলে এসেছি বাসা থেকে। কিন্তু সেদিকে নজর দিলে আমার ভ্রমনের আনন্দ মাটি হবে এই চিন্তা করে মন থেকে তা ঝেড়ে ফেলে দিলাম। কিন্তু চিন্তাটা আরেক জায়গায়। আকাশের কোণে মেঘ জমেছে, জমাট কালো মেঘ। একটু আগে যে মৃদু স্নিগ্ধ হাওয়া বইছিল তাও এখন থেমে গেছে। এখন প্রকৃতি অসম্ভব নীরব। গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। লক্ষণ ভালো না, নির্ঘাত ঝড় হবে!

এসব ভাবতে ভাবতে পুকুর পাড়ের একটা ঝোপের সামনে উবু হয়ে একটা অচেনা হলুদ ফুল দেখছি এমন সময় বৃষ্টির প্রথম ফোঁটাটা আমার মাথায় পড়লো। তারপর আমাকে কোনোরকম বুঝতে না দিয়েই ঝুম করে শুরু হল তুমুল বর্ষণ সাথে কান ফাটানো বজ্র-নিনাদ। দৌড়ে গিয়ে একটা বড় গাছের নিচে দাঁড়ালাম। গাছটা চিনতে পারলাম না, যদিও চেনার মতো অবস্থা তখন আমার নেই। এই বৃষ্টি থেকে বাঁচতে পারলেই রক্ষা। কিন্তু এই বজ্রপাতে গাছের নিচে থাকাও ভয়ঙ্কর, এই ভেবে আশেপাশে তাকাতেই কিছুটা দূরে আবছা আবছা যেন একটা বাড়ি দেখতে পেলাম। ছুট লাগালাম সেদিকে। বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত মাটির রাস্তায় যেখানে আমার মতো শহুরে মানুষের হাঁটাই দায়, সেই রাস্তায় কি করে দৌড়ে বাড়িটার সামনে পৌঁছুলাম তা ওপরওয়ালাই ভালো জানেন।

বাড়িটার সামনে দাঁড়াতেই প্রথমবারের মতো স্পষ্ট দেখলাম বাড়িটাকে। ভাঙ্গা পুরনো টিনের দোচালা বাড়ি। দরজায় একটা তালা লাগানো বটে। কিন্তু তার নিতান্তই কোন দরকার নেই। কারন দরজার একটা পাল্লা এমনিতেই হা হয়ে খুলে আছে। সেই ফাঁক দিয়ে ঢুকে পরলাম বাড়িটাতে। যা হয় হোক।

ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা, গুমোট গন্ধ ঘিরে ধরল আমাকে। ভেতরটা পুরোপুরি অন্ধকার। বাইরে তখনও বৃষ্টি পড়ছে, তা টিনের চালে এক সুরে ঝম ঝম বাজিয়ে চলেছে। সাথে কিছুক্ষণ পর পর প্রচণ্ড বজ্রপাতে কানে তালা লাগা অবস্থা। আশপাশটা দেখার জন্য পকেট থেকে ফোনটা বের করে তার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বাললাম। সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ধক করে উঠলো, জ্বলজ্বলে দুটো চোখ মুহূর্তেই যেন সরে গেলো আমার সামনে থেকে! সেদিকে আলো ফেলতেই বুঝলাম ওটা একটা বিড়াল। আলো দেখে এখন দাঁত খিঁচিয়ে একটা অদ্ভুত শব্দ করছে। আমার উপস্থিতি তার মোটেও পছন্দ হয়নি এই বোঝাতে চাইছে বোধয়। আমার মতো সে বেচারাও হয়তো আশ্রয়ের জন্য ঢুকেছে। মনে মনে একটু হেসে নিলাম, কতটা ভীতু আমি!   

চারপাশে আলো ফেলে ভালো করে দেখে নিলাম ঘরটা। কালের বিবর্তনে বাড়িটা এখন ভাঙ্গা আর পরিত্যক্ত হলেও এক সময় যে বেশ আলিশান বাড়ি ছিল তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। ভেঙ্গে যাওয়া বাঁকানো কাঠের সিঁড়ির ওপর বিবর্ণ গালিচা আর ওপরের সিলিং থেকে ঝোলা ঝাড়বাতির আংটা সেই সাক্ষ্যই দেয়। ওপরের চালটা একটা জায়গায় ভাঙ্গা, সেখান থেকে বাইরের বৃষ্টির ছাঁট আসছে। আমি ফোনটা হাত নিয়ে এক-পা, দু-পা করে উঠতে লাগলাম সিঁড়ি বেয়ে। প্রাচীন কাঠের সিঁড়ি মড়মড় করে আমার পায়ের নিচে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। কিছু জায়গা ক্ষয়ে গেছে বলে বেশ সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। কার বাড়ি এটা? কত পুরনো এই বাড়ি? এই সম্পর্কে তো কোথাও কিছু পড়িনি। মামাও বলেননি কিছু। সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় উঠে যেতেই নিচ থেকে একটা কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ কানে এলো। সেদিকে ফিরতেই পায়ের নিচের কাঠের পাটাতন নড়ে উঠলো আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই মড়মড় শব্দে ভেঙ্গে পড়লো আমাকে নিয়ে। তারপর আর কিছু মনে নেই!  

ঠিক কতক্ষণ পড়ে ছিলাম জানি না। জ্ঞান ফিরে পেতেই উঠে বসার চেষ্টা করলাম কিন্তু মাথার পেছনে তীব্র একটা ভোতা যন্ত্রণা অনুভব করলাম। চোখে তখনও ঝাপসা দেখছি। বেশ কিছুটা সময় লাগলো সম্বিত ফিরে পেতে। তারপরই একটা প্রচণ্ড আতঙ্ক ঘিরে ধরল আমাকে। এ কোথায় পড়ে আছি আমি! এই কি সেই ভাঙ্গা দোচালা বাড়িটা যাতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম! যেন মনে হচ্ছে বাড়িটা তার আদি রূপে ফিরে গেছে। মাথার ওপর ঝুলছে ঝাড়বাতি। তার আলোয় পুরো বাড়িটা যেন ঝলমল করছে। মেঝেটাও চকচক করছে। সেই ভাঙ্গা সিঁড়িটা একদম নতুন এখন। তার ওপর টকটকে লাল গালিচা তার শোভা বর্ধন করছে। ঘরের কোনায় কোনায় লন্ঠন জ্বালানো। স্বপ্ন দেখছি নাতো? বুঝতে পারছি আমার মস্তিষ্ক উত্তেজিত হয়ে আছে। আমার হৃদ-স্পন্দন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি আমি। প্রতিটা শিরায়, ধমনিতে প্রচণ্ড গতিতে সঞ্চালিত হচ্ছে রক্তস্রোত। প্রতিটা নিউরন সেল উত্তেজনা বহন করছে শরীরের শেষ প্রান্ত অবধি।

কাঁপা কাঁপা হাতে পকেটে হাত ঢোকালাম। স্মোকিং ছেড়েছি বেশিদিন হয়নি। এখনও মাঝে মাঝে শরীর নিকোটিনের অভাব অনুভব করে। নিজের অজান্তেই হাত চলে যায় পকেটে একটা সিগারেটের আশায়। এখনও ঠিক তাই হচ্ছে। উত্তেজিত মস্তিষ্ক প্রতিটা রক্তকণায় নিকোটিনের অভাবের বার্তা পাঠাচ্ছে। যার ফলে আরও উত্তেজনা অনুভব করছে আমার শরীর। ফোনের কথা মনে পড়তেই চারপাশ চেয়ে দেখালাম আমার ফোনটা নেই! অথচ যতটুকু মনে পড়ে ফোনটা হাতেই ছিল আমার। গেলো কোথায়?  উঠে বসলাম কষ্ট করে। যন্ত্রণাটা এখন আর তেমন অনুভব করছি না।

হঠাৎ এক নারী কণ্ঠের প্রচণ্ড চিৎকারে সমস্ত বাড়িটার নীরবতা একটা কাঁচের মতো ভেঙ্গে দিলো। ওপর তলা থেকে আসছে সেই চিৎকার। সাথে কিছু পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি, আর কাঠের পাটাতনে বুট পড়ে হাঁটার মতো ঠক ঠক শব্দ। গায়ের রক্ত হিম হয়ে এলো আমার। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা বরফ শীতল স্রোত বয়ে গেলো। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘না… না… এ নির্ঘাত আমার স্বপ্ন। এখনই ভেঙ্গে যাবে আর নিজেকে আমি নিজের বিছানায় আবিষ্কার করবো’। কিন্তু সেই চেষ্টা বৃথা। আবার ভেসে আসছে চিৎকারের আওয়াজ। এবার একটা নয়, অনেকগুলো নারী কণ্ঠ যেন আর্তনাদ করছে, কাঁদছে, চিৎকার করছে। সেই সাথে পুরুষ কণ্ঠের অট্টহাসি।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। এক-পা, এক-পা করে এগিয়ে গেলাম সিঁড়ির দিকে। আওয়াজটা এখনও আসছে। তারই উৎস ধরে উঠছি সিঁড়ি বেয়ে। হাত কাঁপছে ক্রমশ। মস্তিস্ক বারবার বার্তা দিচ্ছে, বিপদ বিপদ! কিন্তু আমি এগুচ্ছি প্রচন্ড ভয় আর কৌতূহল নিয়ে, এক পা দু পা করে এগুচ্ছি। দোতলায় বেশ কয়েকটা ঘর নজরে পড়লো আমার। সবগুলোরই দরজা লাগানো। দরজায় লাল জড়ি দেয়া পর্দা। আওয়াজটা আসছে একদম কোণার ঘর থেকে। এগিয়ে গেলাম সেদিকে। দরজাটার দুই পাল্লা একটু ফাঁক করা। একটা পাল্লা খুলে ভেতরে উকি দিতেই একটা চিৎকার করে পিছিয়ে এলাম! না… না… এটা স্বপ্ন! এ কিছুতেই বাস্তব হতে পারে না। ঘরময় ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো তরুণীর মৃতদেহ। মেঝে সয়লাব হয়ে আছে জমাট রক্তে। মৃতদেহগুলো এতো বীভৎস বলার মত না! খুব বিচ্ছিরি এবং হিংস্রতার সাথে মারা হয়েছে তাদের। কোন দেহেই বিন্দু মাত্র কাপড় নেই, পুরোপুরি নগ্ন! সারা গায়ে অত্যাচারের চিহ্ন আর ছোপ ছোপ রক্ত। কেউ যেন ধারালো কোনকিছু দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করেছে দেহগুলি! তরুণী দেহগুলোর কোনটার চোখ উপড়ে ফেলা তো কোনটার স্তন থ্যাতলানো! কোন কোনটার যোনিপথ ক্ষতবিক্ষত! আবার সেই চিৎকার! দেহগুলো যেন চিৎকার করছে….আমার দিকেই তাকিয়ে… আর সইতে পারলাম না। জ্ঞান হারালাম!

একটা পরিচিত কণ্ঠের ডাকে জ্ঞান ফিরলো। আমায় নাম ধরে কেউ ডাকছে, অস্পষ্ট হলেও শুনতে পারছি, ‘আবীর… আবীর…’। চোখে ঝাপসা দেখছি। সারা শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা! মাথার ভেতর যেন কিছু একটা ভোঁ ভোঁ করছে। খুব পরিচিত একটা গান বাজছে কোথায় যেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা লাইন কানে আসছে, so you run…and run… it’s sinking… সুরটা খুব পরিচিত। কিন্তু ধরতে পারছি না। আবার সেই ডাক, ‘আবীর… আবীর…’। কিছুটা সম্বিত ফিরে পেতেই তীব্র আলোয় চোখ ধাধিয়ে গেলো। হাত দিয়ে চোখ ধেকে চিৎকার করলাম, ‘কে? কে?’

আবার সেই পরিচিত কণ্ঠ, ‘আমি রে… বড় মামা’।

এতক্ষণে হুশ এলো। আমি কিছু একটা বলতে গিয়েও গোঙ্গানোর মতো আওয়াজ করলাম। শুনতে পেলাম মামা কাকে যেন বলছে, ‘এই ধর তো, দুজনে ধরে নিয়ে রিকশায় বসাই’।

আরেকজন এসে আমার বাঁহাতটা তার কাঁধে নিলো আর মামা ডান হাতটা। তারা দুজনে আমাকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। বৃষ্টি থেমে গেছে। পথ কাঁদায় মাখামাখি। হঠাৎ কে যেন দৌড়ে এলো। বলতে লাগলো, ‘সার আমার মাইয়াটারে দেখসেন? এইখানেই ধইরা আনসিলো তারে’।

কণ্ঠটা পরিচিত, কথাগুলাও। কোথায় যেন দেখেছি লোকটাকে। মনে করতে পারছি না। শুধু ভোতা একটা যন্ত্রণায় কিছু আবছা আবছা মনে পড়ছে, ‘ঝড়… একটা বাড়িতে ঢুকলাম, সেই চিৎকার…’ তারপর আর কিছু আসে না মাথায়। তীব্র যন্ত্রণায় সব যেন ঝাপসা হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর লোকটাকে চিনলাম। সেই প্রথমদিন, অটোরিকশার ভাড়া দেয়ার সময় দেখেছিলাম। সেই পাগলটা।

মামা প্রচণ্ড হুংকার ছেড়ে ধমক দিয়ে বলল, ‘যা তো! বিপদের সময় যতসব উটকো ঝামেলা!’

আমাকে ধরে একটা রিকশায় বসালো দুইজনে। তারপর মামা আমাকে দু হাতে শক্ত করে ধরে আমার পাশে বসলো। কি যেন বলছেন উনি আমাকে। আমি আবছা আবছা শুনছি কিন্তু বুঝতে পারছি না। ব্যাথাটা আবার বাড়লো। মাথার ভেতর আবার সেই পরিচিত গানটার ভাঙ্গা লাইন, run… run… but it’s sinking…। কোন ব্যান্ডের গান এটা? খুব চেনা কিন্তু মনে পড়ছে না। ‘কি যেন নাম! একটা রঙের নামে নাম… পার্পল? নাকি…’ আর মনে পড়লো না। আবার জ্ঞান হারালাম।

তারপর ২ দিন কিভাবে কেটেছে আমার তেমন একটা মনে নেই, গায়ে প্রচণ্ড জ্বর ছিল। মাঝে মাঝে চোখ খুলতে দেখতাম মামা পাশে বসে। আবার ঘুমিয়ে পরতাম। ৩য় দিন কিছুটা সুস্থ হলাম। গায়ে তখনও প্রচণ্ড ব্যাথা! মাথায় ভালই আঘাত লেগেছে। সেদিনের ঘটনাটা আবছা আবছা মনে পরতে লাগলো। সেই চিৎকার। সেই রুমে দেখা বিভীষিকাময় সেই দৃশ্যগুলো চোখে ভাসতে লাগলো। তারপরই মনে পড়লো সেই পাগলটার কথা, ‘সার, আমার মাইয়াটারে…’। সেই বাড়িটা আসলে কি? কি হতো তার ভেতর? কেনই বা ওসব দেখলাম?

কিছুক্ষণ পর মামা এলেন ঔষধ খাওয়াতে। আমাকে বসা অবস্থায় দেখে হেসে বললেন, ‘দুইটা দিন জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকেছিস। আজ দেখা যায় সুস্থ বেশ তুই! ডাক্তার বলেছিলেন সময় লাগবে সাড়তে। ভয় পেয়েছে বিধায় এতো জ্বর’।

আমি সেসব না শুনে সরাসরি বললাম, ‘আচ্ছা মামা, ওই বাড়িটা…’

মামা আমার কথা শেষ করার আগেই বললেন, ‘তুই ওই বাড়িতে ঢুকেছিলি কেন? সেদিন সেই যে বেরুলি আর আসার নাম নেই। তার ওপর এই ঝড়-বাদল। ছাতা হাতে বেরুলাম খুঁজতে। খুঁজতে খুঁজতে সেই বাড়িটার সামনে আসতেই দেখি তার দরজার পাল্লা একটা ভেঙ্গে আরেকটার সাথে ঝুলছে। ভাবলাম একটা উঁকি দিয়ে দেখি। ভেতরে টর্চের আলো ফেলতেই দেখলাম তুই পড়ে আছিস মেঝেতে’।

আমি বললাম, ‘মামা, ওইটা বাড়িটা কার? গঠন দেখে বেশ আলিশান মনে হল’।

মামা বললেন, ‘এক সময় ওটা এক জমিদারের বাংলো ছিলো বলে শুনেছি’। শুরু হল মামার লেকচার। মামা কথা বলেন রীতিমত লেকচার দেয়ার ভঙ্গিতে। দীর্ঘদিন মাস্টারির ফল। মামা বলতে লাগলেন, ‘জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ার পর সে বাড়ি ইংরেজদের ক্লাব হাউজ হিসেবে ব্যাবহার হয়েছিলো অনেকদিন। তারপর ভারত ভাগ হল আর ইংরেজরাও দেশ ছাড়লো। বাড়িটা পড়ে রইলো তার মতই। একাত্তর সাল। যখন যুদ্ধ পুরোপুরি মাত্রায় চলছে।নীলগঞ্জ স্কুল, যেটার আমি এখন হেডমাস্টার সেটায় খান সেনারা ঘাঁটি গাড়লো। আর সেই দোচালা বাড়িটা ছিলো তাদের টর্চার সেল! কত নিরীহ লোককে যে ধরে নিয়ে অত্যাচার করেছে ইয়ত্তা নেই। আর তার চেয়েও ভয়ঙ্কর বিষয়, গ্রামের সুন্দরি তরুনি, যুবতি মেয়েদের শান্তি কমিটির লোকেরা ধরে ধরে চালান করতো সেই বাড়িতে। তাদের ওপর হিংস্র খান সেনারা চালাতো অমানুষিক নির্যাতন। তাদের ধর্ষণ করে নির্মম ভাবে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুন করা হতো। তারপর লাশ ফেলে দিতো নদীতে। সেসব লাশ দেখার মতো ছিল না! বীভৎস! কারো গায়ে কাপড় নেই। লজ্জাস্থান ক্ষতবিক্ষত, কোনটার স্তন খুবলে তুলে ফেলা হয়েছে তো কোনটার চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে বেয়নেটের খোঁচায়! সেই পাগলটাকে দেখেছিলি না তার মেয়ের খোঁজ করতে? সে বেচারার বউটাকে তার সামনে খুন করে খান সেনারা। মেয়েটাকে লুকিয়ে রেখেও বাঁচাতে পারেনি শেষ অবধি। মেয়েটাকে ধরে নিয়ে যায় সেই বাড়িটায়। তারপর তার লাশও খুঁজে পায় নি কেউ। বেচারার আজ এই অবস্থা, এখনও ওই বাড়ির আশেপাশে ঘোরে আর যাকেই পায় তার মেয়ের কথা জিজ্ঞেস করে’। 

মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে যেন সব ভেসে উঠলো এক এক করে। সেই চিৎকার, সেই বীভৎস নগ্ন লাশগুলোর আর্তনাদ, সেই দানবীয় অট্টহাসি! সেদিন তাহলে আমার সামনে সেই কালো ইতিহাসের কোন এক পাতাই খুলে গিয়েছিলো অলৌকিকভাবে। নিজের চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি সে সব নরপশুদের কর্মকাণ্ড! সেই অমানুষিক কর্মকাণ্ডের অভিশাপ নিয়ে দোচালা বাড়িটা আজও দাঁড়িয়ে আছে অকপটে। কালের সাক্ষী হয়ে!      

 

-সমাপ্ত-

     


Comments

Popular posts from this blog

রসুলপুর স্টেশন

খুনী

কথা ও আকাশ