প্রশ্ন
আর কিছুক্ষণ পরই নতুন সূর্য উঠবে। নতুন একটি দিন শুরু হবে। রাতের অন্ধকার মুছে দিয়ে সূর্য তার কোমল আলোয় প্রভাতকে আলোকিত করে দিবে। কিন্তু সেই আলোয় আলোকিত হওয়ার সৌভাগ্য হয়তো আমার হবে না। এই ডায়রির আর কোন পাতায় তোমাকে নিয়ে আর কিছু লিখব না।
এই ডায়রিটা তুমিই আমাকে দিয়েছিলে, মনে পড়ে? বলেছিলে শুধু তোমাকে নিয়ে যেন লিখি ডায়রিতে। আমি তোমার কথা রেখেছি। মোটা এই ডায়রির প্রতিটা পাতায় তোমাকে নিয়ে লিখেছি। কিন্তু তোমাকে পড়তে দেইনি কোনদিন। ভেবেছিলাম সবগুলো পাতা শেষ হয়ে গেলে ডায়রিটা তোমাকেই উপহার দিব। কিন্তু সেই সুযোগ তুমি দাওনি।
যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম আজও সেদিনের কথা মনে পড়ে। তুমি ক্যাম্পাসের বাইরের বাগানটায় বসে ছিলে। কাছ দিয়ে হেঁটে গেছি কিন্তু কথা বলার সাহস হয়নি। সেদিন তোমার সাথে কথা বলার জন্য অজানা এক কারনে মনটা কি পরিমাণ ব্যাকুল হয়েছিলো তা তুমি জানলে না।
কথা বলার সুযোগ আরেকদিন পেয়েছিলাম লাইব্রেরীতে। সেই প্রথম তোমার সাথে কথা বলা। তারপর এক এক করে প্রতিটি দিন। পার্কের রাস্তায় পাশাপাশি হাঁটা থেকে শুরু করে ক্যাফেতে বসে কফি খাওয়া, প্রতিটা মুহূর্ত আমার মনে আছে। শুধু যে মনেই আছে টা না। প্রতিটা স্মৃতি আমার মনে কাঁটার মতো বিঁধে আছে। সেগুলো মনে করলে কাঁটা বিদ্ধ মনের ক্ষত আরও যেন বেড়ে যায়। তবুও মনে করি বার বার। তোমার কি আর মনে আছে!
বিয়ের পর নর্থ ডেকোটায় নতুন বাসায় তোমাকে নিয়ে উঠলাম। তোমার উৎসাহ দেখে আমার মনে হয়েছিলো পৃথিবীর সমস্ত সুখ পেয়ে গেছি। তুমি সারাদিন খুব ব্যাস্ত সময় কাটাতে নিজের মতো করে ঘর গোছানতে। আমাদের ছোটো ঘরটাকে তুমি নিজের মতো করে সাজিয়ে তুলেছিলে।
তোমাকে নিয়ে যখন দেশে আসি তুমি প্রথম প্রথম বলেছিলে আমার দেশটা অনেক গরম আর ‘ডাস্টি’। কিন্তু ট্রেনে করে যখন তোমাকে নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছিলাম তখন তুমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলে জানালা দিয়ে। আমি যে তোমার পাশে বসে আছি হয়তো তুমি ভুলেই গিয়েছিলে। তুমি ভীষণ অভিমানী ছিলে। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বললে, ‘তোমার দেশটা এতো সুন্দর কেন? আমার হিংসে হচ্ছে’। আমি হা হা করে হেসে উঠতেই তুমি লজ্জায় আমাকে জড়িয়ে ধরলে। ওটা ছিল আমার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর একটি। তোমাকে আমার গ্রামটা ঘুরে দেখা;লাম। জোছনা রাতে তোমাকে নিয়ে নদীর পাড়ে হাঁটলাম। তুমি মুগ্ধ হয়ে বললে, ‘এতো সুন্দর জোছনা আমি আগে কখনও দেখিনি। সত্যি বলছি’। তারপর আবার অভিমানী সুরে সেই প্রশ্নটা করলে, ‘তোমার দেশটা এতো সুন্দর কেন?’
আবার ফিরে এলাম আমেরিকায় তোমাকে নিয়ে। আমি পিএইচডির কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরলাম। তুমি সংসারে মন দিলে। ‘টক্সিক কেমিক্যালস’ ছিল আমার গবেষণার বিষয়। সারাদিন বিষাক্ত রাসায়নিকগুলোকে নিয়ে কাজ করতে হতো। বিশেষ করে সায়ানাইড গ্রুপের যৌগগুলো। কাজ করার জন্য বাসারই এক ছোট্ট ঘরকে গবেষণাগার বানিয়ে নিলাম। সারাদিন কাজ করতাম আর সারারাত ভরে থিসিস লিখতাম। সকালে প্রফেসর একটানে কেটে দিয়ে গাঁট গাঁট করে বলতেন, ‘রাবিশ! ডু ইয়োর জব প্রপারলি। আদারওয়াইজ আই এম এডভাইজিং ইউ নট টু ট্রাই ফর পিএইচডি। ইটস নট ইয়োর জব ইয়াং ম্যান’।
প্রফেসরের কড়া কথা শুনে রাগে কট কট করে বাসায় ফিরতাম। তখন সবকিছুই আমার অসহ্য লাগতো। এমনকি তোমার কথাও। যে তোমার কথা না শুনলে আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না সে তোমার কথাও আমার কাছে বিষাক্ত মনে হতো।
আমি দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করতে লাগলাম। কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি আমি নিজেই তিল তিল করে তোমার আমার মাঝে কতটা দুরত্ব সৃষ্টি করছি। তোমাকে আমি দূরে ঠেলে দিতে লাগলাম একটু একটু করে। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি আদৌ তা চাইনি। আমি বুঝতে পারিনি আমাদের মাঝের এই দুরত্ব কতটা পাহাড়সম অভিমান জমা করেছিলো তোমার বুকে। যার ফল আমি একদিন পেয়েছি।
অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে পিএইচডি ডিগ্রি দিতে রাজি হল। সেদিন আমার আনন্দ দেখে কে! এক তোড়া ফুল কিনে বাসায় ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম তোমায় চমকে দিব। জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলব, ‘আর কোন দুরত্ব নেই! আর নেই!’ কিন্তু আমি পারিনি।
ফুল হাতে ঘোরে ঢুকতে গিয়ে দেখি দরজা ভেতর থেকে লক করা। একটা চাবি আমার পকেটেই থাকে। তা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আমি থমকে দাঁড়ালাম। মুহূর্তে গোটা দুনিয়ে অন্ধকার হয়ে এলো আমার সামনে। দেখলাম তুমি মেঝেতে পড়ে আছো আর তোমার হাতের পাশেই পটাশিয়াম সায়ানাইডের একটা ছিপি খোলা বোতল। আমার বুঝতে দেরি হয়নি গোটা বিষয়টা।
আমি হেরে গেলাম তোমার অভিমানের কাছে… হেরে গেলাম! ধর্ম মতে তোমার হয়তো নরকেই স্থান হবে। কিন্তু কি জানো তো, আমার এখন আর স্বর্গে যেতে ইচ্ছে করে না। কি লাভ বল স্বর্গে গিয়ে, যেখানে আমি তোমাকে পাবো না।
সেই সায়ানাইডের বোতলটা এখন আমার সামনে। খুব বেশি তাতে নেই। তবে প্রাণ কেড়ে নিতে এতটুকুই যথেষ্ট। এখন আমার আর কোন চিন্তা নেই। কেবল একটা প্রশ্নই বারবার মনের মাঝে উঁকি দিচ্ছে। আমার জীবনের শেষ প্রশ্ন। “আচ্ছা, তোমার যে নরকে স্থান হয়েছে, মৃত্যুর পর আমি যদি সে নরকে যেতে চাই ঈশ্বর কি আমার অনুরোধ রাখবেন?”
-০-

Comments
Post a Comment